Prottashitoalo

বঙ্গবন্ধুর মানবিক গুনাবলী ও ধর্মীয় চেতনা

0 619

বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ব্যক্তি জীবনে সহজ সরল ও মানবিক গুন সম্পন্ন একজন মানুষ। সম্ভ্রান্ত মুসলিম এক পরিবারে জন্ম গ্রহণের ফলে ছোট বেলা থেকেই নৈতিকতার চর্চা ও অন্যায়ের প্রতিবাদ তাঁর শিরায় শিরায় প্রবাহিত ছিল। মানবিক গুনাবলী ও নৈতিকতার চেতনার কেন্দ্র ধর্মীয় চেতনা শিক্ষা তার মনো জগতে তীব্রতর ছিল। আর তাই বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের সীমাহীন শ্রদ্ধা করতেন। ‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার সময় অধ্যাপক সাইদুর রহমানের পায়ে হাত দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে দেখেছি।’ (বঙ্গবন্ধু ও তার শিক্ষকগণ) তিনি আলেম-উলামাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে খুব সম্মান করতেন। তিনি পূর্ব বাংলার বিখ্যাত আলেম, যিনি ‘সদর সাহেব হুজুর’ নামে পরিচিত, আল্লামা সামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) সম্পর্কে লিখেন, “গোপালগঞ্জে আমার নিজের ইউনিয়নে পূর্ব বাংলার এক বিখ্যাত আলেম মওলানা শামসুল হক সাহেব জন্মগ্রহণ করেছেন। আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। তিনি ধর্ম সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন।’’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২৫৬)

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর জীবনে ইসলামী মূল্যবোধের বিকাশ

১৯৪৩ সালে মন্বন্তরের সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ওই সময় দুর্ভিক্ষের অবস্থা, বেকার হোস্টেলের ছাত্রদের সহায়তা এবং কলেজের শিক্ষক সাইদুর রহমান, আই এইচ জুবেরী, নারায়ণ বাবুসহ অধ্যাপকদের সহমর্মিতা সম্পর্কে জানা যায় বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে। তিনি লিখেছেন, ‘এই সময় শহীদ সাহেব লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলি লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। মুসলিম লীগ অফিসে, কলকাতা মাদ্রাসা এবং আরও অনেক জায়গায় লঙ্গরখানা খুললাম। দিনভর কাজ করতাম, আর রাতে কোনো দিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, কোনো দিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২৫৬) নিরন্নকে অণ্যদান, অসহায়কে সাহায্য প্রদান- এসব মানবীয় গুনাবলি ইসলামের অনবদ্য শিক্ষা; যা বঙ্গবন্ধুর ব্যাক্তি জীবনে আমরা দেখতে পাই। ধর্মীয় চেতনায় বলিয়ান একজন মানুষের পক্ষেই এই স্বার্থপর দুনিয়ায় অন্যের জন্য সময় ও ত্যাগ স্বীকার করা সম্ভবব হয়।

বঙ্গবন্ধু জন্মভূমির মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য এদেশকে, এদেশের মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। আর দেশকে ভালোবাসা ইসলামের একটি ইবাদাত। এটিকে ঈমানের অঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ দেশ না থাকলে মুসলিমরা কোথায় তাদের ধর্মীয় উপাসনা স্বাধীনভাবে চর্চা করবে। বঙ্গবন্ধু বলেন, “মুসলিম লীগ ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করলেও জনগণের প্রয়োজন ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। … স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে যেতে হবে।” (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, পৃ. ৭৮-৭৯)

মূলতঃ তিনি এ দেশের প্রতি ভালবাসার কারণেই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের চেয়ে অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতি বেশী নজর দিয়েছেন। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছিল পূর্ব পাকিস্তানে তখন। ১৯৪৭-৬৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। শুরুতে জাতীয় আয়ের প্রায় ৫২% ই ছিল পূর্ব বাংলার অবদান। কিন্তু ১৯৫৯-৬০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আঞ্চলিক আয় বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৯-৫০ সালের উভয় প্রদেশের মধ্যে বৈষম্যের মাত্রা ছিল ১৯%। ১৯৫৯-৬০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩২% এবং ১৯৬৫-৬৬ সালে তা আরো বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫৫% এ। ১৯৬৪-৬৫ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় বৈষম্য ছিল ৪৬%।

১৯৪৭-৬৬ সালের মধ্যে যে বৈদেশিক সাহায্য দেশের উন্নয়নে ব্যয় হয় তার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল মাত্র ৩৪%। ব্যাংক, বীমা, শিল্প কলকারখানার মালিকানা এককভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে চলে যায়। (মুনতাসীর মামুন ও মোঃ মাহববুর রহমান, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, পৃ. ১৬৭) শুধুমাত্র স্বার্থ হাসিলকারীরাই ধর্মকে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য হাতিয়ার হসিবে ব্যবহার করে থাকে। জন্মভূমির প্রতি সীমাহীন ভালবাসার শক্তিই তাঁকে নৈতিক বলে বলিয়ান করে নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক করে তুলেছে। আজ বাংলাদেশে যার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে।

বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন শেষে বিমান বন্দর থেকে লাখো মানুষের গগনবিদারী জয় বাংলা শ্লোগানের মধ্যদিয়ে একটি খোলা ট্রাকে রেসকোর্স ময়দানে এসে হাজির হলেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে তিনি এখানে তার বক্তব্যে ইন্দোনেশিয়ার পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হিসেবে অখ্যায়িত করলেন। একই বক্তৃতায় তিনি আবার রাষ্ট্রীয় চার স্তম্ভের মধ্যে একটি ধর্মনিরপেক্ষতার কথাও বলেলন। (বাংলাদেশ বাহাত্তর থেকে পাচাত্তর, পৃ. ৩১) ধর্ম নিরপেক্ষতাকে তিনি ধর্মহীনতা হিসেবে দেখেননি। (বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম পৃ. ১৭১) আসলে তিনি প্রগতিশীল চেতনার পাশাপাশি ইসলামী চেতনাও মনোজগতে ধারণ করার এটা একটি প্রমাণ বহন করে। আবার ১৯৭২ সালে সৌদি আরবে মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে ছয় শতাধিক বাংলাদেশি মুসলমানকে হজ্ব পালনে প্রেরণ করা হয়।

আরও পড়ুন: ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন

বাংলাদশেে ইসলামরে প্রতি বিশ্বাস বিপন্ন, পাকিস্তানিদের এমন প্রচারণার জবাবে মুসলমি বিশ্বের উদ্দেশ্যে তিনি বলছেনে, “কেবল ইন্দোনশেয়িার পরইে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র।” তাদরে মনোযোগ আর্কষণ করে তিনি আরো বলনে, “ইসলামরে নামে এ দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুসলমানদের মেরেছে, অসম্মান করেছে নারীদের। আমি ইসলামকে অসম্মান করতে দিতে চাই না।” তিনি তদন্তরে জন্য একটি আর্ন্তজাতকি ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং পাকস্তিানি সনোবাহনিী র্কতৃক বাংলাদেশে চালানো গণহত্যার পরসির নির্ধারণের আহ্বানও জানান জাতসিংঘকে। তাঁর বক্তব্যে মুসলমান হত্যাকে ইসলামের প্রতি অসম্মান হিসেবে বিবেচনা করাকে ইসলামের প্রতি গভীর অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি জালিমদের বিরুদ্ধে বাঙালি মাজলুমদের সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু এ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। এটি ছিল ইসলামেরই খেদমত। ইসলাম জিহাদ হিসেবে উল্লেখ করেছে জালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাকে। জালিম যদি মুসলিমও হয়, তার বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ আল-কুরআনে রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যদি ঈমানদারদের দুইদল একে অপরের সাথে লড়াই করে তাদের মধ্যে আপস করিয়ে দাও। এরপর যদি একদল অপর দলের সাথে বাড়াবাড়ি করে, তাহলে যে দল বাড়াবাড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা লড়াই কর; যতক্ষণ না সে দলটি আল্লাহর হুকুমের দিকে ফিরে আসে।” (আল-হুজরাত: ০৯)

হাদীসে এসেছে, “জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেন, তোমরা জুলুম করা থেকে দূরে থাক। কেননা জুলুম কিয়ামতের দিন অন্ধকারাচ্ছন্ন ধোঁয়ায় পরিণত হবে।” (রিয়াদুস সালেহীন- ২০৩) বছরের পর বছর বাঙালীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। এ জুলুম অত্যাচার আর বঞ্চনার নিগড় থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি কষ্ট স্বীকার করে সীমাহীন ত্যাগ-তীতিক্ষার ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা দানের মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছেন এ জাতিকে। ধর্মীয় অনুপ্রেরণাও এখানে ছিল।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু বেতারে ভাষণ দেন। ঐ ভাষণে তিনি একটি চমৎকার বিষয়ের অবতারণা করেন। নামসর্বস্ব বা অনুষ্ঠান সর্বস্ব মুসলিম না হয়ে সত্যিকারের মুসলিম এবং ইসলামের পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, “আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই, এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য আমরা লেবাসসর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রাসূলে করীম (সা.) এর ইসলাম। যে ইসলাম জগতবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র।” (বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম, পৃ. ১৭০)
১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের আলোচনার জন্য যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সে অধিবেশনে তিনি ধর্ম নিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা নয় বলে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার স্ব-স্ব অধিকার অব্যাহত থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মচর্চা বন্ধ করতে চাই না এবং তা করবোও না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রের কারো নেই।” (বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম, পৃ. ১৭১) এ অনবদ্য ঘোষণার মাধ্যমে তাঁর ধর্মীয় চেনতার প্রকাশ ঘটে।

মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
পিএইচডি গবেষক
ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Comments
Loading...