সেদিন ছিল আমার বাবার জন্য জ্যোৎস্না রাত
নানীর কাছে গল্পে গল্পে শুনেছি, এগুলো আমার জানার কথা নয়, কারণ আমি সেদিন মাত্রই পৃথিবীতে এসেছিলাম। যে মুহূর্তে আমার বাবা শুনেছিলেন আমি পৃথিবীতে এসেছি; সে মুহূর্তে আমাকে এক পলক দেখার জন্য তাঁর চিত্তটা এতই দৃঢ় হয়ে ওঠে যে, ঘুটঘুটে অন্ধকারের রাস্তাটা তার কাছে মনে হয়েছিল জ্যোৎস্না রাত। শ্মশান ঘাটটাও সেদিন তার কাছে মনে হয়েছে রাস্তার ধারের কোনো বাড়ি-ঘর।
নব্বইয়ের দশকে আজকের মতো এতটা মোটরসাইকেলের বাহার ছিল না, বাস-ই ছিল ভরসা। তাই দ্রুত কোথাও যাওয়াও যেত না। আমার নানী বাড়ির পথটা হেঁটেই পাড়ি দেয়া লেগেছে তখন। পথটা রাতের জন্য ছিল বেশ দুর্গম পাহাড় পাড়ি দেয়ার মতো। গ্রামের রাস্তাটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটি খাল, পাশেই শ্মশানঘাট। তখন একটু সন্ধ্যা হলেই এই জায়গাটা নিয়ে গ্রামের মানুষের মনে ভিতির সঞ্চার হতো।
সন্ধ্যার পর এই পথে চলাচল কমতে থাকে, আর রাত হলে তো কথায় নেই। বাঁশের সাঁকো দিয়ে খাল পার হয়েই আরেকটি শ্মশান। তারপর প্রায় এক থেকে দেড় কিলো মিটার পথ হাঁটতে হবে। মাঝে পার হতে হয় বাঁশবাগান আর বেশ কিছু জঙ্গল; যেখানে সূর্যের আলোই ঠিকমতো প্রবেশ করতো না, সেখানে এই রাত!
তো যাই হোক, ফিরে আসি আমার মূল স্মৃতিতে। আমার বাবা চাকরির সুবাদে তখন যশোর ছিলেন। তিনি তার স্যারের মোটরসাইকেলের পেছনে খাবারের বক্স নিয়ে বসে যাচ্ছিলেন। ওই স্যার তখন যেতে যেতে খবরটা দেন। আমার বাবা মোটরসাইকেল থামিয়ে এক মুহূর্তও দেরি করেননি। চাকরি থাক বা না থাক সেটা তিনি ভাবেননি। সোজা রওয়ানা হন মাগুরার পথে। সময়টা ছিল পড়ন্ত বিকেল। বাস ধরতে ধরতেই রাত হয়ে যায়।
মাগুরায় ফিরে পায়ে হেঁটেই রওয়ানা হন আমার নানী বাড়ির পথে। শহর থেকে প্রায় সাত থেকে আট কিলোমিটার পথ। এরপর নানীবাড়ির সেই গ্রামের পথ।
তখন রাত নেমেছে ধরণীতে। অন্ধকারের রাতে খালের পাশে গা ছমছমে পরিবেশের শ্মশান ঘাটটাও যেন আমার বাবার চোখে হয়ে ওঠে একটি সাধারণ বাড়ি! সুদূর মেঠো পথ, বাঁশবাগান, জঙ্গল পাড়ি দিয়ে গিয়ে মাঝরাতে উঠানে গিয়ে নানীকে ডাক দেন বাবা। নানী এক ডাকেই সাড়া দেননি। কারণ গ্রামের মানুষের মাঝে একটা কথা প্রচলিত আছে- রাতে কারো এক ডাকে সাড়া দিতে নেই, অন্তত তিনটা ডাক দিলে তবেই।
যাই হোক, আমার বাবার তিন-চারটা ডাকের পর নানী চেরাগ (কেরোসিন তেলের ল্যাম্প বা বাতি) জ্বালিয়ে ঘরের দরজা খোলেন। সেদিন চেরাগের ফিনফিনে আলোটা আমার বাবার জন্য সূর্যোদয়ের আলো মনে হচ্ছিলো। আর আমি তো ছিলাম আমার বাবার প্রথম সন্তান….
গণমাধ্যম কর্মী