কোমলমতি নারী তোমার পদে পদে বিড়ম্বনা
নারী বিড়াম্বনার শিকার হয়েছে কালে কালে। হয়ত তার ধরণটা পাল্টেছে।
“খ্যাতির আশায় ঘুরে ঘুরে
হারিয়েছে সবাই হুশ
খ্যাতির যে বিড়ম্বণা আছে
ভুলে গেছে মানুষ।”
‘নারী’ অতি কোমল একটি শব্দ। কবিদের লেখার অর্ধেকটা জুড়েই থাকে এই নারীর বহু গুণের বর্ণনা। হয়ত কবিদের লেখা পড়েই আমরা অভ্যস্ত হয়েছিলাম নারী একটি কোমল শব্দ। কারণ বর্তমানে নারী শব্দটির সঙ্গে কোমল শব্দটা বেমানান হয়ে উঠেছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে নির্যাতিতা, ধর্ষিতা, শ্লিলতাহানির শিকার, বিড়াম্বনার শিকার ইত্যাদি। শুধু বর্তমান বললেও ভুল হবে। কারণ নারী বিড়াম্বনার শিকার হয়েছে কালে কালে। হয়ত তার ধরণটা পাল্টেছে।
সর্বকালেই বিড়াম্বনার শিকার:
অতিতে নারীরা প্রতিবাদ করতে তেমন একটা সাহস পাননি। তাদের প্রতিবাদের মিছিলও ভারি হতো না, তারা এগিয়ে যেতেও পারেননি। তৈরি হতো না প্রতিবাদ করার প্লাটফর্ম। ফলে অনেকেই সব সহ্য করে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেছেন, কেউবা বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ। সেক্ষেত্রে অনেক না বলা কথা শোনা হয়নি আমাদের। তখন বিড়াম্বনার শিকার হওয়া নারীর আর্তচিৎকারটা বহুদূর পৌঁছায়নি। এতে আমরা ধরেই নিই অতিতে নারী নির্যাতন কম হয়েছে। তবে নানি-দাদিদের মুখে শুনলে ধারণা পেতে পারেন- অতিতে নারী কতোটা বিড়াম্বনার শিকার হয়ে থাকতেন, কতটা নির্যাতন সহ্য করতেন, কতটা স্বপ্ন মাটিচাপা দিয়েছেন।
কালের বিবর্তনে তৈরি হয়েছেন অনেক সাহসী নারী। যাদের বদৌলতে আজ নারীরা অধিকার আদায়ে কথা বলতে শিখেছে। প্রতিবাদ করতে শিখেছে, রুখে দাঁড়াতে শিখেছে। মিছিলে মিছিলে চিৎকার করে নিজের অধিকারের কথা বলতে শিখেছেন। তৈরি হয়েছে নানা প্লাটফর্মও। স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করতে যাওয়া, বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত হওয়া, ইন্টারনেট ব্যবহার করা। তাতে কি? নারীর কথা বলা বা প্রতিবাদ করার জায়গাটা যত বেড়েছে, নারীর সাথে ভিন্ন পথ অবলম্বন করে অপরাধ করার প্রবণতাটাও কিন্তু সমানতালে বেড়েছে। শুধু পার্থক্য এটাই যে- কোনো নারী বিড়াম্বনার শিকার হলে তা আজ দশজনের কানে পৌঁছাচ্ছে।
সমাজে অনেকেই মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়াকে ভালো চোখে দেখেন না। অতিতের কথা নাইবা বলি, বর্তমানেও কিন্তু এমনটা আছে বহু। হয়তো শিক্ষিতোর মুখোশ পরে থাকা বাবাটা তার মান-সম্মানের ভয়ে বলে বসবেন মেয়ে হওয়াতে আমি বড্ড খুশি। কিন্তু তিনিও ভবিষ্যতের কথা ভেবে দির্ঘশ্বাস ছাড়েন অজান্তেই। সবার ধারণা মেয়েকে বিয়ে দিলেই পর, তাহলে তাকে নিয়ে এত আয়োজন করার কি আছে? অনেককেই বলতে শোনা গেছে, তোমার ঘরে এ নিয়ে কয়টা মেয়ে হলো? আরেকটা বিয়ে করো, নইলে আর ছেলের মুখ দেখতে পাবে না, বংশের ভবিষ্যৎ তো মেয়ে নয়! যুগ অনেক পাল্টেছে। প্রযুক্তির কল্যানে এখন গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে তা আগে ভাগেই জানা যায়। তো প্রযুক্তির কল্যানে যুগ এগিয়ে গেলেও মানুষের নেতিবাচক চিন্তাধারাও বেড়েছে। কারণ গর্ভের সন্তান যখন মেয়ে বলে জানা গেছে, তখন গর্ভধারীণীর প্রতি সহিংসতাও বেড়ে গেছে। হাতে গোনা কয়েকজন নারী এক্ষেত্রে সৌভাগ্যবতী। আর দেশে তো এখন আল্ট্রাসনোগ্রাফির অনেক চিকিৎসকই বলতে চান না গভের সন্তান ছেলে না মেয়ে। এখানেও ফ্যাক্ট সেই মেয়ে নিয়ে। বোঝাই যায় মেয়ে সন্তান আর নারী কতটা অবহেলিত।
নারীর শিক্ষা-দীক্ষা, বিয়ে:
মেয়ে সন্তান বলে অনেক সময় মানুষ হতেও তেমন একটা জোর দেয়া হয় না সমাজে- সে যতই চিৎকার করে সমান অধিকারের কথা বলা হোক না কেন। সমাজের এমন কিছু মানুষের মতে- কি হবে মেয়েদের পড়ালেখা করিয়ে? সেই তো শ্বশুরবাড়ি গিয়ে চুলার ছাই কাঁড়তে হবে! অথচ যে মেয়েটা পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হতে পারলো না, দশজনের সাথে চলা শিখলো না, মানুষ চেনা শিখলো না সেই মেয়েটাই কি-না শ্বশুরবাড়ির অচেনা ভূবনে সংসার সামলাচ্ছে। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে দূর-দূরান্তের স্কুল-কলেজে যাচ্ছে। কতদিকই না সামলাচ্ছে সেই নারী। তবুও কোনো কাজে পান থেকে চুনটা খসলেই শুনতে হবে ওই নারীকে- কি করো সারাদিন? শুনতে হয় নানা রকম কটু কথাও। বাপের বাড়িতে গিয়ে আগের মতো আপন করে এ ঘর-ও ঘর ছুটে বেড়ানো যাই না। কিছু হলেই শুনতে হয় এটা এখন তার বাড়ি নয়। তার বাড়ি শ্বশুরবাড়ি। শুধু তাই-ই নয়, নারীদেরকে বাবার বাড়ি থাকতেই শেখানো হয় শ্বশুরবাড়িই তোমার দ্বিতীয় আশ্রয়। সেখানে মারুক-কাটুক সব সহ্য করে পড়ে থাকবা মা! সব শুনেও পড়ে থাকতে হচ্ছে একই জায়গায়। যেন খাচার ভেতর ছটফট করা পাখি। দিন শেষে পাশে বসে হাতটা ধরে শোনার কেউও নেই সেই নারীর পাশে। ভুগে থাকেন ডিপ্রেশনেও।
সমাজে অনেকেই আছেন যারা মেয়েকে সন্তান হিসেবে দেখেন না। দেখেন মেয়ে হিসেবে। অনেকে ধর্মের দোহায় দিয়ে বলে বসেন যার ঘরে চার-পাঁচটা মেয়ে আছে সে জান্নাতি হবে। কথাটা ধর্মের দিক থেকে সংবেদনশিল হলেও কতটা যত্ন করি নারীদের?
কর্মক্ষেত্রে কতটা স্বাচ্ছন্দে নারীরা:
আজ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ঘরের বাইরে যাচ্ছে নারী। সংসারের খরচ চালাতে চাকরি, ব্যবসা সবই করছে। কিন্তু অর্থকড়ি ইনকাম করলেও এখানেও ভালো আছে কতজন নারী? চাকরি ক্ষেত্রে তাদেরকে হতে হয় বৈষম্যের শিকার। নানান উচু পদগুলোর জন্য যোগ্যতা থাকলেও নারীকে ভরসা করতে পারেন না অনেক প্রতিষ্ঠান। এতো গেলো বৈষম্যের কথা। এরপরে প্রতিটি নারীকেই শুনতে হয় অফিসে তুমি কতটা নিরাপদ। কারণ প্রত্রিকা খুললেই নানা জায়গায় কিছু না কিছু নারীর শ্লিলতাহানি, খুন, ধর্ষনের খবর থাকবেই থাকবে। অফিসের বস হয়ত একা ভেতরে ডাকলে বুকটা কেঁপে উঠতেই পারে নারীর। চাকরি বাঁচাতে অনেককে অনেক কিছু মেনেও নিতে হয়। এরপর তো রইলো সবার কানাঘুষা। হয়ত অফিসে অনেককে টপকে কোনো ভালো কাজের দায়িত্ব পেয়ে গেলেন নারী। সেক্ষেত্রে শুধু মাত্র নারী হওয়ার কারণেই অন্যান্যদের নোংরা মন্তব্যের শিকার হতে হয় নারীকে।
“একদিন বুঝবি সেদিন
যেদিন পাবি বিড়ম্বনা
হতে চাবি সেদিন সাধারণ একজন
বিড়ম্বনা তবু পিছু ছাড়বেনা।“
রাস্তায় এবং পাবলিক বাসে যাতায়াত:
নারীরা রাস্তায় নিরাপদ নয়। যত ভিড় যেন নারীর আশে-পাশেই। চলতে পথে অনায়াসের অচেনা কারো হাত এসে পড়ে নারীর দেহে। বিব্রতকর মনটা নিয়ে কিছুক্ষণ থমকে গিয়ে আবার চলতে শুরু করে নারী। চলার পথে খুব কম নারীর ধাক্কাই লেগেছে শরীরে। কিন্তু প্রতিদিন কোনো না কোনো পুরুষের ধাক্কা লেগেই থাকে। নারী দেখলেই রাস্তায় চলতে পথে অপর লিঙ্গের মানুষের কনুইটা ডানে-বামে উঁচু হয়ে ওঠে। যেন ওই কনুইয়ের প্রবল সখ কোনো নারীকে ছুঁয়ে দেখার!
আরও পড়ুন- ছুটি বাড়ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
ভিড়ের রাস্তা যেমন বিব্রতকর তা চেয়ে বড় ভয়ংকর হলো নির্জন আর ফাকা রাস্তা। একটু নির্জন রাস্তায় কোনো নারীকে একা পেলেই শুরু হয় শ্লিলতাহানির মতো কারবার।
আর পাবলিক বাস, সে তো আরো নোংরামির জায়গা। সুযোগ পেলে বাসে সাবধানে উঠিয়ে নেয়ার নাম করে হেলপারটাও নারীর পিঠে হাত বুলিয়ে দেখেন। পাশের ছিটে পুরুষ বসলে যেন নারীর জন্য জায়গা কম হয়ে ওঠে। নেহাত জায়গা কম হওয়াই নারীকে কিছুক্ষণ ছুয়ে বসে থেকে মনের সাধ মেটান পাশের লোকটা। আরো নোংরা মানসিকতার কেউ যদি বাসে উঠে সিট না পান তাহলে তার দাঁড়ানো সুবিধাজনক স্থানটা হলো নারীর সিটের পাশে।
শুধু আমাদের দেশে নয়, আমরা যেসব দেশকে উন্নত দেশ বলে থাকি সেসব দেশের নারীরাও বিড়াম্বনার শিকার হন প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে বৈষম্য তো রয়েছে সব ক্ষেত্রেই। আজ নির্যাতন, অপহরণ, ধর্ষণ –খুন বেড়ে যাওয়ায় আজ সর্বক্ষেত্রেই নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠছে। শক্ত শক্ত কথা আর প্রতিবাদে মুখর সবখানেই দেখা মিলছে। তারপরও প্রত্রিকা খুললে নতুন কোনো ধর্ষণের খবর চোখে পড়ছে। শুধু ধর্ষণই নয় নির্যাতন, নির্যাতন সইতে না পেরে নারীর আত্মহত্যার মতো খবরও আসছে প্রতিদিন। বিধাতার সৃষ্টি পুরুষ-নারী আমরা সবাই। তাহলে নারীর পতি সবখানে কেন এত সহিংসতা, কেন নারীরা সর্বক্ষেত্রে বিড়াম্বনার শিকার? আর কবেই বা মিলবে এসবে প্রতিকার?